আসাদুজ্জামান ফজলু, দিগন্তবার্তা. কম, ৮ ডিসেম্বর:-
আজ ৮ ডিসেম্বর। ময়মনসিংহের ভালুকা মুক্ত দিবস। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালে এই দিনে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর কবল থেকে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে কয়েক হাজার রাজাকার আলবদর পাক সেনার আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ভালুকা পাক হানাদার মুক্ত হয়। এই দিনে বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীনতার লাল সবুজের পতাকা উত্তোলন করেন। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকবাহিনী ঢাকায় আক্রমণ করলে সে দিন থেকেই সারা বাংলাদেশে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। শ্রীপুর, ত্রিশাল, গফরগাঁও, ফুলবাড়িয়া, ভালুকা উত্তরাঞ্চলীয় প্রবেশদ্বার ৭১ রণাঙ্গনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জনপদ ছিল।
১৯৭১ সালে ৭ মার্চ জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ সোনার পর থেকে ভালুকা উপজেলার সর্বস্তরের জনগণ মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। মুক্তিযোদ্ধ পরিচালনার জন্য দেশ প্রেমিক, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিক নেতা কর্মীসহ সর্বস্তরের জনগণের উপস্থিতিতে ভালুকায় গঠন করা হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ। ওই পরিষদের নেতৃত্বে ছিলেন প্রয়াত ফসার উদ্দিন আহম্মেদ।
ব্রিটিশ ভারত সেনাবাহিনী (অব:) সুবেদার তৎকালীন ভালুকা থানা আওয়ামীলীগের সহ সভাপতি আফসার উদ্দিন আহম্মেদ ১৯৭১ সালে তৎকালীন ভালুকা উপজেলার রাজৈ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হামিদ মেম্বারের কাছ থেকে একটি মাত্র রাইফেল নিয়ে ও আট জন সদস্য নিয়ে ভালুকা উপজেলার মল্লিকবাড়ী ইউনিয়নের মল্লিকবাড়ী বাজারের খেলু ফকিরের বাড়িতে মুক্তি বাহিনীর একটি গেরিলা দল গঠন করেন।
পরবর্তীতে ভালুকা থানা দখল করে ১৪/১৫ টি রাইফেল ও একটি এল, এম, জি সহ প্রচুর গোলাবারুদ সংগ্রহ করেন। এর কয়েক দিনের মাথায় কাউরাইদ হতে খীরু নদী ভালুকা থানায় আসার পথে ভালুকা উপজেলার রাজৈ ইউনিয়নের পনাশাইল নামক স্থানে পাকিস্তান পাক হানাদার বাহিনীর অস্ত্র ও গোলা-বারুদ সহ একটি নৌকা আটক করে মুক্তিযোদ্ধারা। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করে গেরিলা একটি দল শক্তিশালী বাহিনীতে পরিণত হয়। আফসার উদ্দিনের আট সদস্যের একটি দল পরবর্তীতে প্রায় সাড়ে চার হাজার মুক্তিযোদ্ধার বিশাল একটি বাহিনী গড়ে উঠে।
এফ জে ১১ নম্বর সেক্টরের ময়মনসিংহ জেলা দক্ষিণ ও ঢাকা জেলা উত্তর সাব সেক্টর অধিনায়ক মেজর আফসার ব্যাটেলিয়ান নামে পরিচিত লাভ করে। যুদ্ধকালীন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের দ্রুত চিকিৎসার জন্য ডাক্তার রমজান আলী তরফদার তত্ত্বাবধানে পাঁচজন ডাক্তার দশজন সহকারী ও চারজন নার্সর সমন্বয়ে আফসার ব্যাটালিয়ন হাসপাতাল নামে একটি ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল পরিচালিত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে কিছুদিন রেডক্রস সংস্থার দ্বারা পরিচালিত হয়।
১৯৭১ সালে ২৫ জুন শুক্রবার সকাল হতে ভালুকা গফরগাঁও সড়কের ভাওলিয়াবাজু নামক স্থানে শিমুলিয়া নদীর পাড়ে পাকিস্তানের পাক বাহিনীর সঙ্গে আফসার বাহিনী সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হন। দিবা রাত্রি দীর্ঘ ৩৬ ঘণ্টা একটানা যুদ্ধ স্থায়ী হয়। শুক্রবার শুরু হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাক বাহিনী চারিদিকে পানি বেষ্টিত নদীর পূর্বপারে গোয়ারী যোগীপাড়া নামক স্থানে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। শুক্রবার সারাদিন সারারাত তিন দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে অনেক পাকসেনা নিহত হয়।
পরদিন শনিবার সকাল ১১টার দিকে ঢাকা হতে আকাশ পথে আসা পাক হানাদার বাহিনী হেলিকপ্টার থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান লক্ষ করে ভারি মেশিনগানের সেলিং শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারাও হেলিকপ্টার লক্ষ করে পাল্টা ব্রিটিশ এল এম জি’র সাহায্যে গোলা বর্ষণ অব্যাহত রাখলে হেলিকপ্টার পিছু হটে। পরে শনিবার সন্ধ্যায় দিকে যুদ্ধক্ষেত্রে চার কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে ধলিয়া গ্রামে ধলিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে হেলিকপ্টার থেকে পাক সেনা নামিয়ে দিলে মুক্তিযোদ্ধারা ডিফেন্স ছেড়ে চলে আসেন।
এই যুদ্ধে আফসার বাহিনীর তরুণ যোদ্ধা অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র মল্লিকবাড়ী আব্দুল মান্নানের মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। মজিবর রহমানসহ আহত হয় আরও পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধারা নদীর পশ্চিম দিকে একটানা দুদিন সম্মুখ যুদ্ধ করায় পাক সেনা নিহত হয়।
১৯৭১ ঐতিহাসিক ওই যুদ্ধের খবর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, অল-ইন্ডিয়া রেডিও ও বিবিসি হতে ফলাও করে সম্প্রচার করা হয়। এই যুদ্ধের পরে ভালুকা থানা ও বাজার এলাকায় পাক বাহিনীর ক্যাম্পটি শক্তিশালী করা হয়। স্থানীয় মুসলিমলীগ নেতারা এখানে গড়ে তোলেন একটি বিশাল রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প। এসব রাজাকার আলবদররা ভালুকা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে দিনের পর দিন মানুষ হত্যা, নারী ধর্ষণ, বাড়িঘরে অগ্নি সংযোগ লুটপাট চালায়।
আফসার বাহিনী যুদ্ধকালীন বিভিন্ন সময় একাধিক বার ভালুকা পাকহানাদার ক্যাম্পে আক্রমণ চালিয়েছে। এছাড়া আমলীতলা যুদ্ধে, বল্লা যুদ্ধ, ত্রিশাল, গফরগাঁও, ফুলবাড়িয়া, শ্রীপুর, ভালুকা উপজেলার মল্লিকবাড়ী, মেদুয়ারীসহ বিভিন্ন স্থানে পাক সেনা ও রাজাকারদের সঙ্গে আফসার বাহিনীর অসংখ্য যুদ্ধ হয়। দীর্ঘ ৯ মাসের বিভিন্ন যুদ্ধে প্রয়াত ফসার উদ্দিন আহম্মেদের ছেলে নাজিম উদ্দিনসহ ৪৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছিলেন।